যশোরের লেবুতলায় যাত্রীবাহী বাস ও ইজিবাইকের সংঘর্ষের পর যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত শিশু খাদিজা। বাসের চাপায় তার দুই যমজ ভাই, নানি, খালা আর খালাতো বোনের প্রাণ গিয়েছে। মা এখন হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তবে ভাগ্যক্রম বেঁচে যাওয়া পাঁচ বছরের খাদিজা এখনও এসবের কিছুই জানে না।
শনিবার দুপুরে হাসপাতালের মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, আহত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় কাকার কোলে শুয়ে আছে খাদিজা। তার শরীরের ক্ষত ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। তবে মন ভালো নেই তার। দুর্ঘটনার প্রভাব এখনও তার মন থেকে যায়নি।
স্বজনরা তাকে বলেছেন, সবাই ভালো আছে, দুই-একদিন পরই দেখা হবে। মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কেঁপে উঠছে তাদের কণ্ঠস্বর। ছোট্ট মেয়েটিকে মর্মান্তিক এ খবর দেয়ার সাহস এখনও কেউ করে উঠতে পারেননি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় যশোর-মাগুরা মহাসড়কের লেবুতলার তেঁতুলতলা বাজারে যাত্রীবাহী বাস একটি ইজিবাইককে চাপা দিলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার সময় চালকসহ ইজিবাইকে মোট ৯ যাত্রী ছিলেন। বাসচাপায় চালকসহ সাতজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। শিশু খাদিজা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার মা সোনিয়া খাতুন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি চিকিৎসাধীন।
দুর্ঘটনার পর অচেতন অবস্থায় স্থানীয়রা খাদিজাকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের বেডে কাকা রনি হোসেনের কোলে বসে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল অবুঝ শিশুটি। তাকে জিজ্ঞেস করতেই আধো আধো স্বরে বলে উঠল, ভালো আছি।
তোমার কী হয়েছে- প্রশ্ন করতে তার উত্তর, আমাদের গাড়িতে বাস ধাক্কা দিছে। আমি পড়ে গেছিলাম। পড়ে যেয়ে কান্না করছিলাম।
তার পর কী হয়েছে, সেটা আর বলতে পারেনি সে। মুখ ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে ছিল।
খাদিজার কাকা রনি হোসেন বলেন, খাদিজার গলায় টিউমার ছিল। এটি অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকেলে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি ক্লিনিকে যাচ্ছিল। তেঁতুলতলা বাজারের মহাসড়কে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বেশ খানিকটা সামনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের পরিবারের পাঁচজন মারা যায়। এর মধ্যে বেঁচে যায় খাদিজা আর ওর মা।
তিনি আরও বলেন, রাত ৯টার দিকে খাদিজার জ্ঞান ফিরলে মায়ের খোঁজ করে। তাকে বলেছি, মা বাইরে আছে। তুমি সুস্থ হও, তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব। মাঝে মধ্যে ওর ভাইদেরও ডাকছে। বাবা চাকরির সুবাদে বাইরে থাকায় তাকে বেশি ডাকছে না।
তাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হৃদয় কেঁপে উঠছে বলে জানান রনি।
খাদিজার ফুফা জাকিরুল ইসলাম বলেন, খাদিজার মাথায় আঘাত লেগে ফুঁলে গেছে; গাল কেটে গেছে। দুর্ঘটনার সময় গাড়ির ভেতরে আটকে ছিল সে। পা ছাড়া শরীরের আর কোনো অংশ বের হয়ে ছিল না। সবাই ভেবেছিল, ও মারাই গেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে ওকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তিনি জানান, তরল জাতীয় খাবার ছাড়া কিছু খেতে পারছে না খাদিজা। তার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। পারিবারিক অবস্থাও বেশি ভালো নয় খাদিজাদের। তবে শত অভাবের মাঝেও সাজানো সংসার ছিল ওদের। সেই সংসার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
যশোর জেনারেল হাসাপাতালে তত্বাবধায়ক ডা. হারুন-অর রশিদ বলেন, মেয়েটির (খদিজা) শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। তবে এ মুহূর্তে পরিবারের মৃত্যুর খবরে তার অবস্থার অবনতি হতে পারে। তাই কাউকে বলতে নিষেধ করেছি।
খাদিজা বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামের হেলাল মুন্সীর মেয়ে। হেলাল ঢাকার হেমায়েতপুরে একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কর্মরত। ঘটনার সংবাদ শুনে রাতেই রওয়ানা দিয়ে ভোরে বাড়ি এসে পৌঁছান তিনি।
স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করতেন হেলাল। ঈদুল আজহায় সবাই গ্রামে এসেছিলেন। ছুটি শেষে হেলাল কর্মস্থলে ফিরে গেলেও যমজ সন্তান হাসান-হোসেন ও মেয়ে খাদিজাকে নিয়ে বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন স্ত্রী সোনিয়া।
শনিবার সকালে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহত ৭ জনের জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
http://dlvr.it/Srt6qD
0 Comments