বৃষ্টি শুরু হলেই দেখা দেয় ঝুঁকি। ধসের ঘটনাও ঘটে নিয়মিত। তবুও বন্ধ হচ্ছে না সিলেটের পাহাড় টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস। ফলে প্রতি বছর বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
ছোটবড় অসংখ্য পাহাড় টিলা নিয়ে গঠিত সিলেট। এসব টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাণহানির শঙ্কাও বেড়েছে।
এমন আশঙ্কার মধ্যেই সোমবার নগরের মেজরটিলা এলাকায় একটি টিলা ধসে মাটিচাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। এতে আহত হন আরও তিনজন।
গত কয়েকদিন থেকেই সিলেটে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে সোমবার সকাল ৬টার দিকে মেজরটিলায় চামেলিবাগ এলাকার দুই নম্বর সড়কের একটি টিলা ধসে ৮৯ নম্বর বাসার ওপর পড়ে। এতে এই বাসায় ভাড়া থাকা ছয় সদস্য মাটির নিচে চাপা পড়েন। তিনজনকে তাৎক্ষণিক জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের আহত অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর প্রায় ছয় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাকি তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহতরা হলেন- ৩১ বছর বয়সী আগা করিম উদ্দিন, তার স্ত্রী ২৫ বছর বয়সী শাম্মী আক্তার রুজি ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম।
প্রতি বছরই সিলেটে টিলা ধসে এমন হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবু টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস থামছে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সিলেটে কী পরিমাণ লোক টিলার পাদদেশে বসাবাস করেন, সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই। তবে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১০ হাজার পরিবার টিলার পাদদেশে বসবাস করছে।
মূলত কম ভাড়ায় কিংবা বিনা ভাড়ায় থাকতে পারার কারণে দরিদ্র শ্রেণির লোকেরাই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। আবার কিছু গোষ্ঠী টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পাদদেশে ঘর বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় বরাদ্দ দেয়।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার ওপরে ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে পুণবার্সনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সিলেটের মেজরিটালার চামেলিবাগে সোমবার এই টিলা ধসে প্রাণ হারান এক পরিবারের তিনজন। ছবি: নিউজবাংলা
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় টিলা-কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদদেশে নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় ও টিলাধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
তিনি জানান, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলায় টিলাধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়।
পাহাড় বা টিলাধসে মানুষের মৃত্যু হলে প্রশাসন কিছুদিনের জন্য তৎপর হয়। তারপর আবার চুপ হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়া এলাকার একটি টিলার নাম জাগো টিলা। উঁচু এই টিলার একেবারে কিনারা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি ঘর। উপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি। টিলার ওপরে ও ঢালে বসবাস করা সবগুলো পরিবারের বাসিন্দারাই রয়েছেন ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছেন এখানে।
জাগো টিলার ওপর ঘর বানিয়ে বাস করা শামসুল ইসলাম বলেন, এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে ঘর বানিয়ে থাকি।
ঝুঁকির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভয় তো আছেই। বৃষ্টির দিনে ভয় আরও বেড়ে যায়; কিন্তু আমরা গরীব মানুষ, জায়গা কেনার সামর্থ নেই, ঘর ভাড়া করাও অনেক খরচের। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলার ওপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই এরকম দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের এসব জায়গায় বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসাব মতে, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪ শ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার ওপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম, জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।
তিনি বলেন, বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।
অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, গাছ উজাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন অনেকে। ছবি: নিউজবাংলা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজর টিলা ও মংলির পাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ পরিবার। এছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।
টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস ও প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একইসঙ্গে পাহাড়-টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুণবার্সসনের নির্দেশনা দেয়; কিন্তু ওই রায়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
শাহেদা বলেন, কী পরিমাণ লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোনো হিসাব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে। সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বারবার এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
এই পরিবেশকর্মী আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিলাখেকোরা টিলা দখল ও কাটার জন্য দরিদ্র শ্রেণির লোকজনদের স্বল্প ভাড়ায় বা বিনাভাড়ায় টিলার ওপরে ঘর নির্মাণ করে দেয়।
সোমবারের দুর্ঘটনার পর নগরে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সব কাউন্সিলরকে সিটি মেয়র নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, সোমবার দুপুরে জরুরি সভায় মেয়র এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। এছাড়া পাহাড় ও টিলার পাদদেশে কেউ যাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করতে না পারে, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক ও পরিবশে অধিদপ্তরের পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি।
তবে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাকারীদের সরানো যায় না বলে দাবি সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসানের।
তিনি বলেন, টিলার ওপরে ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন, চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। গত বছরও আমরা সব ইউএনওদের মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি, কিন্তু কেউ কথা শোনেনি।
তিনি আরও বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। তাদের কীভাবে সরানো ও পুনর্বাসন করা যায়- এ নিয়ে ভাবছি। তাদের মধ্যে যদি কেউ ভূমিহীন থেকে থাকেন, তাহলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।
http://dlvr.it/T87nkD
0 Comments