কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা কালা মিয়া। শৈশব থেকেই তার পেশা সংলগ্ন নাফ নদে মাছ ধরা। এটাই তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ। এই পেশাকে পুঁজি করেই তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এসেও মাছ শিকার করা ছাড়া আর কিছুই জানেন না এই জেলে।
কালা মিয়ার বাড়ি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ায়। নাফ নদের পারে ত্রিপল মোড়ানো তার বাড়ি। বৃষ্টি এলে এবং জোয়ারে পানি ঢুকে পড়ে বাড়িতে। তার আর্তনাদ সেই নোনা পানির জলে আরও বাড়ে। হাতে জাল তুলে নিতে না পেরে তার জীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ।
দীর্ঘ ৬ বছরের বেশি সময় ধরে নাফ নদে জাল ফেলতে পারছে না জেলেরা। কারণ এই সীমান্ত নদে মাছ শিকারে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে মাদক ইয়াবা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে দেয়া এই নিষেধাজ্ঞায় কতটা কার্যকর ফল দিচ্ছে তা ভিন্ন বিষয়। তবে মাছ শিকার করতে না পেরে মরতে বসেছে স্থানীয় জেলে পরিবারগুলো।
টেকনাফে নাফ নদের তীরে রয়েছে- টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়া, কায়ুকখালী পাড়া, সদরের নাজির পাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়া, সাবরাংয়ের নয়াপাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের হোয়াব্রাং, নাটমুড়া পাড়ার জেলে পাড়া, হোয়াইক্যংয়ের খারাইংগ্যাঘোনাসহ আরও কয়েকটি জেলেপ্রধান গ্রাম।
নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। ব্যবহার না হওয়ায় কিছু কিছু নৌকা ইতোমধ্যে অকেজো হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানা নির্ধারক নাফ নদে জেলের জাল পড়ে না দীর্ঘ ছয় বছর ধরে। ছবি: সংগৃহীত
২০১৭ সালের আগস্টের দিকে হঠাৎ করে নাফ নতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা দেয় প্রশাসন। এর ফলে জীবিকা হারিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করছেন কালা মিয়ার মতো ১০ হাজার জেলে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এক বেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা উপোস থাকতে হচ্ছে তাদের।
স্থানীয় শতাধিক জেলে অভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এমনিতেই নাফ নদে নানা সময়ে মাছ ধরার ওপর বিজিবির বিধিনিষেধ থাকে। এই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবা পাচার রোধের দোহাই দিয়ে নাফ নদে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে।
টানা ছয় বছর ধরে এই নিষেধাজ্ঞা চলায় আয়ের পথ হারিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটাচ্ছে প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবার। অথচ ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের পেটে লাথি মারার শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা বলেন, নাফ নদে জাল ফেলার অনুমতি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ ছয় বছর ধরে আমরা অপেক্ষায় দিন গুনছি। এই পেশা তো আর আমরা ছাড়তে পারব না। এখন জীবন-জীবিকর তাগিদে প্রয়োজনে আমরা বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেবো।
এক বোট মালিকের স্ত্রী জুহুরা খাতুন বলেন, রোহিঙ্গা ও ইয়াবার কারণে আমাদের জীবিকার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এটা তো হতে পারে না। আমরা এর সুষ্ঠু প্রতিকার চাই।
টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার দুজন জেলে বলেন, আমাদেরকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। তাতে আমাদের কয়দিন চলে? আমরা অনুদানের চাল চাই না। বরাবরের মতো নাফ নদে মাছ শিকার করেই আমরা বাঁচতে চাই।
নিষেধাজ্ঞার আগে বছরের পর বছর ধরে টেকনাফে নাফ নদে বিহিঙ্গি জাল পেতে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছি। কোনোকালেই এভাবে দীর্ঘদিন মাছ শিকার বন্ধ থাকেনি। বিগত পাঁচ/ছয় বছর ধরে নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার জেলে পরিবারে চলছে দুর্বিষহ অভাবের যন্ত্রণা।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর বলেন, টেকনাফের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ শিকার। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে নাফ নদে মাছ শিকার বন্ধ রাখায় অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে জেলে পরিবারগুলোকে। এগুলো কারও চোখে পড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, ইয়াবা কারবারিরা ঠিকই টাকাপয়সা দিয়ে মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। আর গরিব জেলেদের বিষয়টি কারও ভাবনায়ই আসছে না।
ইয়াবা পাচারের দোহাই দিয়ে এমন পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। গরিব জেলেরা না খেয়ে মারা যাবে, তাদের জীবিকা বন্ধ করে দেয়া হবে- এমনটা মেনে নেয়া সম্ভব না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার।
টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের নিদের্শ বলবৎ থাকায় এখন পর্যন্ত নাফ নদে মাছ শিকারের কোনো সুযোগ নেই। তবে অনুমতি দিলে মাছ শিকার করতে পারবে জেলেরা। মাদক এবং মানবপাচার পাচার প্রতিরোধে বিজিবি সর্বদা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, জেলেদের অনেকেই আমার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে উপর মহলে চিঠি পাঠানো হবে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলেদেরকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা মৎস্য র্কমর্কতা মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার রোধ এবং আইন-শৃঙ্খলাজনিত কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় নাফ নদে মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। তবে প্রকৃত জেলেদের দিনের বেলায় মাছ শিকারের সুযোগ দেয়া দরকার। আমাদের পক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলেকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে।
http://dlvr.it/SwGlXb
0 Comments