তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী) নামে নতুন এক জঙ্গি সংগঠনের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। ২০২৪ সালে দেশে বড় ধরনের নাশকতামূলক হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল সংশ্লিষ্টরা।
জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল মোল্লা নামে এক ব্যক্তি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রহমানির বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি জঙ্গিবাদে জড়ান। হয়ে যান নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।
জুয়েল মোল্লার বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার আজরাপাড়া-দিয়াপাড়ায়। কাজ করতেন বেকারিতে। আনসার আল ইসলামের সদস্য হওয়ায় ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ৯ মাস জেল খাটেন।
জামিনে মুক্ত হয়ে আবার বেকারিতে কাজ শুরু করেন জুয়েল। ওই মামলায় কয়েকদিন আগেও তিনি আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়াতে আর আনসার আল ইসলামে ভেড়েননি।
জঙ্গি সংগঠন তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)-এর প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল মোল্লা। ছবি কোলাজ: নিউজাংলা
এদিকে জেল থেকে বের হওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় জঙ্গি জুয়েলের। আর এই দাম্পত্য বিচ্ছেদ তাকে আরও হিংস্র করে তোলে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতেন না। সবশেষ বেশ কিছুদিন পিরোজপুরে অবস্থান করেন তিনি।
তবে মনে পোষণ করা নতুন খিলাফতের চিন্তা থেকে পিছু হটেননি এই জঙ্গি। নিজেই গঠন করেন তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)। দুই-তিন মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও, পোস্ট ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহে নামেন।
ফেসবুকে সৎ ন্যায়পরায়ণ বাদশা নামে একটি পেজে জুয়েল লেখেন, বাংলার জমিন রক্তের নদীতে পরিণত হবে। এই পোস্টে গাজওয়াতুল হিন্দের সৈনিক নামে একটি আইডি থেকে কমেন্টে প্রশ্ন করা হয়- কবে? উত্তরে জুয়েল সৎ ন্যায়পরায়ণ বাদশা পেজ থেকে রিপ্লাই দেন, ২০২৪ সালে।
জুয়েল একটি ফাঁকা ট্রেনে বসে লাইভে এসে নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম প্রকাশ করে জঙ্গি মতবাদ প্রচার করেন।
পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) নিয়মিত সাইবার পেট্রলিংয়ে ১৫-২০ দিন আগে এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের রামপাল থেকে জুয়েল মোল্লাকে আটক করে পুলিশ। তার তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মো. রাহুল হোসেনকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে এবং গাজিউল ইসলামকে রাজধানীর ভাসানটেক থেকে আটক করা হয়।
পরিচয় অনলাইনে, আগে থেকেই ওরা জঙ্গি
এটিইউ-এর সহকারী পুলিশ সুপার এইচ এম মাহবুব রেজওয়ান সিদ্দিকী নিউজবাংলাকে বলেন, জুয়েলের সঙ্গে রাহুলের পরিচয় হয় অনলাইনে। তাদের মধ্যে অনলাইন, অফলাইন দুই মাধ্যমেই যোগাযোগ হতো। তারা নিয়মিত ভিডিও কলে কথা বলতেন। তবে পরস্পর দেখা হয়নি।
রাহুল ও গাজিউল পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দা। তারা দুজনই আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাওহীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের এলাকার আরও ৩-৪ জন নাম লিখিয়েছে নতুন এই সংগঠনে। তারাও আগে হিজবুত তাওহীদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বানচাল করে উগ্রবাদী ব্যবস্থা কায়েমের জন্য এসব জঙ্গি একত্রিত হচ্ছিলেন।
মাহবুব রেজওয়ান বলেন, গাজিউলকে আটকের পর তার মোবাইল ফোনে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে এটিউ। শনিবার তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর রোববার আদালতে তোলা হবে। সেখানে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। এরপর গাজিউলের মোবাইল ফোন সেটটি পাঠানো হবে ফরেনসিকে।
এটিইউ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী কারাগারে ৯ মাস বন্দি থাকার সময়ে জেলখানার মসজিদে মুয়াযযিনের দায়িত্ব পালন করেন জুয়েল। অল্প সময়েই মানুষের মগজ ধোলাই করে নিজের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এই জঙ্গির।
জুয়েলের ভাষ্য, ১৯২৪ সালে খেলাফত শেষ হয়ে গেছে। ঠিক ১০০ বছর পর ২০২৪ সালে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ বিষয়টি আমি স্বপ্নে পেয়েছি, যা সংগঠনের সদস্যদের মাঝে প্রচার করা হয়েছে।
জঙ্গি সংগঠনটির পতাকার নকশা সম্পর্কে জানতে চাইলেও স্বপ্নে পাওয়ার দাবি করেছেন এই জঙ্গি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিদের মধ্যে হওয়া ম্যাসেজ আদান-প্রদানের স্ক্রিনশট।
সন্ধান যেভাবে
সহকারী পুলিশ সুপার মাহবুব রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, নিয়মিত সাইবার পেট্রলিং করতে করতে আমরা দেখলাম নতুন মেসেঞ্জার গ্রুপ, নতুন কিছু লোকজন। এই সংগঠনের প্রধান জুয়েল মোল্লা প্রথমে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলেন। ধীরে ধীরে সদস্য বেড়ে গ্রুপটি বড় হয়। জুয়েল প্রথমে জঙ্গি সংগঠনটির নাম দিয়েছিলেন তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ। মেসেঞ্জার গ্রুপে এই নাম নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হলে তাতে আল-জিহাদী যুক্ত করা হয়। জঙ্গি সংগঠনটির নতুন নাম দাঁড়ায় তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী)।
এটিইউর এই কর্মকর্তা বলেন, সাইবার পেট্রলিং করতে করতে আমরা প্রথমে বেশকিছু ভয়েজ ম্যাসেজ পাই। এর মধ্যে বেশ কিছু উগ্রবাদী ভয়েজ ম্যাসেজ পাওয়া যায়। সেগুলোর বক্তব্য এমন যে- দেশে গণতন্ত্র রাখা যাবে না, দেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এখনই কিছু একটা করতে হবে ইত্যাদি। তখন আমরা গুরুত্বসহকারে বিষয়টির দিকে নজর দেই। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ১৩ সেপ্টেম্বর অপারেশন শুরু করি।
তিনি বলেন, আমাদের মনিটরিংয়ের মধ্যেই ১১-১২ সেপ্টেম্বরের দিকে জুয়েল একটি ফাঁকা ট্রেনে লাইভ ভিডিও করে উগ্রবাদী মতামত ছড়ান। লাইভ ভিডিওতে তিনি তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদী) নিয়ে কথা বলেন। যেহেতু তিনি লাইভ করে ফেলেছেন, সেহেতু যে কোনো সময় যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারেন। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম জুয়েল একটু ক্রেজি টাইপের মানুষ। পরে দেখলাম ঠাণ্ডা মাথার লোক।
জুয়েল মোল্লা যেভাবে আটক
মাহবুব রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, ১১ সেপ্টেম্বর জুয়েল ফকিরহাট এলাকায় এক নারীকে দেখতে যান এবং পরদিনই তাকে বিয়ে করেন। তার এক দিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করতে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথমে জুয়েলের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। শপিংয়ে যাওয়া অবস্থায় তাকে আটক করা হয়।
জুয়েলের নবনিবাহিত স্ত্রীও এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, তার স্ত্রী এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ওই নারী ও তার পরিবার জানতই না যে জুয়েল জঙ্গি নেতা। আমাদের কাছে তথ্য ছিল জুয়েল পিরোজপুরে বেকারিতে কাজ করেন। ১৩ তারিখ আমরা সেখানে অভিযান চালাই। তবে তাকে পাইনি।
এটিইউ সূত্রে জানা যায়, জুয়েলরা ৬ ভাই ও ৪ বোন। অন্য ভাইয়েরা রামপাল, ফকিরহাট এলাকায় ব্যবসা করেন। ভাইয়ের এ ধরনের কার্যকলাপে তারাও বিরক্ত। জুয়েল সপ্তম শ্রেণী পাস। তিনি দেখে ও অন্যের বক্তব্য থেকে শিখেছেন। পাশাপাশি গুগলে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক জুয়েল মোল্লা (মাঝে), রাহুল ও গাজীউল। ছবি: নিউজবাংলা
বোমা তৈরির দায়িত্ব ছিল রাহুলের
এটিইউ-এর পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) ছানোয়ার হোসেন বলেন, জয়পুরহাটে রাহুলের জমি আছে। সেই জমি বিক্রি করতে রাহুলকে সাহায্য করছিলেন গাজিউল। অপারেশনের জন্য বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ বিভিন্ন খরচে এই টাকা ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল। এই অস্ত্র ও বোমা দিয়ে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
সংগঠনটির অর্থের জোগানদাতা কারা, এর সদস্য সংখ্যা কত- এমন প্রশ্নে এটিইউর ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. আলীম মাহমুদ বলেন, সংগঠনটিতে এখন পর্যন্ত ৮০ থেকে ৯০ জন সদস্য আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাদের অর্থদাতা কে তা এখনও জানা যায়নি। তবে সংগঠনটির অর্থ সংগ্রহের কাজ করছিল রাহুল। বোমা তৈরির দায়িত্বও ছিল রাহুলের ওপর।
http://dlvr.it/SwBm7m
0 Comments