নির্বাচন এলে ক্ষমতাবানরা নানা রকমভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। ভোট নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। ভোটের ফলাফল নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, ভোট কারচুপিও কারসাজি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু এবার ঠাকুরগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শুধু নিজেদের ভোট দেব না, ভোট পাহারাও করব।
যদি আমার মূল্যবান ভোট নিয়ে কারসাজি হয়, তবে আমার কেন্দ্রে তা প্রতিহত করব। কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রভাবে প্রবাহিত হওয়ার চেয়ে প্রতিবাদী হব।
তপ্ত রোদে রিকশা চালিয়ে এক হাতে চা ও অন্য হাতে বন রুটি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা এলাকার ভোটার আবদুল বাসেত আলী মিয়া।
সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের পাটিয়াডাঙ্গী বাজারে চায়ের দোকানে অন্য ভোটাররাও তার কথা শুনে ঠিক, ঠিক বলে সমর্থন করছিলেন।
রিকশাচালক বাসেত আলী বলেন, আমরা আমাদের ভোটের মূল্য অনেকে বুঝি না। বিগত নির্বাচনে কেন্দ্রে না যেতে হুমকি শুনতে হয়েছে প্রভাবশালীদের। ভোট দিয়ে কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার সময় প্রিসাইডিং অফিসার গড়িমসি করেছে। দাঙ্গা বেধেছে, মানুষ মরেছে। কেউ দায় নেয়নি। আমরা এমন পরিস্থিতি আর চাই না।
যদি নিজের ভোট নিজে রক্ষা করতে না পারি, তবে আমরা সবাই অপরাধী৷ তাই চিন্তা করেছি শুধু ভোট দিব না, ফলাফলে যেন গড়িমসি না করতে পারে, জাল ভোটার কেন্দ্রে প্রবেশ না করতে পারে, এর জন্য নিজের ভোট চোখ-কান খোলা রেখে পাহারা করব। ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ছাড়ব। আমি মনে করি প্রত্যেকটা ভোটার এমন পাহারাদার হলে আমাদের ভোট বিফলে যাবে না।
চায়ের দোকানে বসা বর্ষীয়ান ভোটার জমসেদ আলীর প্রশ্ন, লোকমুখে শুনছি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে স্থানীয় এমপি নাকি কোনো এক প্রার্থীকে সমর্থন করছে। এমপি নিরপেক্ষতার কথা বললেও তার নাম ভাঙিয়ে নির্বাচনের প্রচারণা থামেনি। এমন হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না তো কী? ভোটাররা তো ধারণা করে বসে আছে ভোট দিয়ে কী হবে, এমপি যাকেই চাইবে সেই জিতবে।
সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আশঙ্কাও রয়েছে এ ভোটারের।
এই বৃদ্ধের কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন তরুণ ভোটার রবিনাথ বর্মণ ও আনোয়ার হোসেন।
তাদের একজন বলেন, যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের মূল্য কি নেই? যদি এমনটাই হয়, তাহলে নির্বাচনের অর্থ আমরা কি বুঝি? আমরা প্রত্যেকে যদি এমন ভীতিকর ধারণা থেকে নিজেদের বের করে নিজের চিন্তা কাজে লাগিয়ে যোগ্য লোককে ভোট দিই এবং সে ভোট রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ হই, তবে কোনো প্রভাবই আমাদের প্রবাহিত করতে পারবে না।
অতএব আমরা ভোট দেব। ভোটের দিন ক্ষমতা বলেন আর প্রভাব, তা শুধু ভোটারের। কোনো এমপির নয়, কোনো মন্ত্রীর নয়, কোনো একটি পরিবারের নয়। আমরা নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কাছে নির্বাচন কমিশনের কাছে এবং প্রশাসনের কাছে একটি পক্ষপাতহীন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বুঝে নেব। যদি কোনো রকম প্রহসনের আভাসও পাই, তবে তা আমরা ভোটাররা রুখে দেব।
নির্বাচনকে ঘিরে নানা জল্পনা শুধু চায়ের দোকানে নয়; এটি ছড়িয়েছে ফসলের মাঠেও।
ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মহাসড়কের দুই পাশে আবাদি জমি। সেখানে আমন ধানের বীজ থেকে চারা উৎপাদনের কাজ করছিলেন একদল কৃষক। ভোট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল সেখানেও।
সব মিলিয়ে প্রচার-প্রচারণা আর প্রার্থীদের রঙিন পোস্টার, মাইকিং ও গণসংযোগে প্রাণবন্ত ও মুখরিত নির্বাচনি প্রান্তর। সুষ্ঠু ভোটের প্রত্যাশার কমতি নেই এসব ভোটারের।
কৃষক হাসান আলী বলেন, আমরা তো ভোট দিই। কিন্তু অনেক বছর ধরে ভোটের মজা পাই না। ভোটের প্রতি আস্থা উঠে গেছে। আমরা আমাদের ভোটের আমানত রক্ষা করতে পারি না। যদি আমাদের ভোট চুরি হয়, এর দায় আমাদেরই।
যে যাই বলুক না কেন, বাক্সের ব্যালট পাহারা না দিতে পারলে ভোটের মূল্য কোনো দিনও থাকবে না। কাজেই আমরা প্রহসনের নির্বাচন চাইব না; প্রভাবের নির্বাচন চাইব না।
তিনি বলেন, আমার ভোট আমি দেব, আপনার ভোট আপনি দেবেন। কোনো নেতার কথায় এবং কারও চোখ রাঙানিতে আমার ভোট প্রবাহিত হবে না। আমি পছন্দমতোই ভোট দেব। যদি আমার ভোট নিয়ে কোনো ছলাকলা হয়, তবে পালাবার সব পথ আটকে দেব।
আসন্ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিযোগিতা করা প্রার্থীরা হলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অরুনাংশু দত্ত টিটো, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কামরুল হাসান খোকন ও জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি রওশনুল হক তুষার।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন করে প্রার্থী প্রতিযোগিতা করছেন।
যেসব কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ
জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে ভোটারের সংখ্যা চার লাখ ৮৭ হাজার ১৭৫। আগামী ২১ মে ১৮৫টি কেন্দ্রে এসব ভোটার তাদের ভোট দেবেন।
রুহিয়া থানার ভোটকেন্দ্রগুলো এবং সদর থানার বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা প্রস্তুত এখনও চলছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে যা বললেন রিটার্নিং অফিসার
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার সোলেমান আলী বলেন, নির্বাচনে আচরণবিধি দেখার জন্য তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছে। নির্বাচনের দিন যাতে পৌরসভাসহ প্রত্যেকটি ইউনিয়নে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকে, সে জন্য আমরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে জানিয়েছে। এ ছাড়াও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বিজিবি, র্যাব, আনসার, পুলিশ তো থাকবেই।
নির্বাচনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রিটার্নিং অফিসার বলেন, নির্বাচনে কোনো ব্যক্তির প্রভাবে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ নেই। কেউ এমন করে থাকলে অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে সকল প্রস্তুতি নেয়া আছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটারগণ নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।
http://dlvr.it/T6vPnj
0 Comments