জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার ভারত সফর আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক গোলামি চুক্তির নব সংস্করণ বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।
দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন তা গোলামির নব সংস্করণ মাত্র। কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে যা করা হয়েছে, তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে রোববার বিকেলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির এই অবস্থান তুলে ধরেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা-স্মারক প্রসঙ্গ ছাড়াও সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যেরও বিশ্লেষণ করেছে বিএনপি।
জনম্যান্ডেটবিহীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ভারত সফর আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক গোলামি চুক্তির নব সংস্করণ শীর্ষক লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, এসব চুক্তি-স্মারকের মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী।
বিএনপি মনে করে, বস্তুত এসব সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নিরাপত্তা কৌশলগত বাফার স্টেট হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে চাযন। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে। যে সাতটি সমঝোতা স্মারক নতুন করে সই করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক।
দলটির দাবি, প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিকেন নেককে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব সমঝোতা চুক্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই চুক্তি জনগণ মেনে নেবে না।
ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা হারিয়েছেন শেখ হাসিনা
বিএনপির মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে আমাদের সব সমস্যাই তো সমাধান হয়ে গেলো। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সাধারণ কূটনৈতিক দর কষাকষির ন্যূনতম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সংবাদ সম্মেলনে তিস্তার পানির অভাবে পর্যুদস্ত অসহায় মানুষের আর্তনাদকে শেখ হাসিনা প্যাঁ প্যাঁ করা বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা সমগ্র জাতির সঙ্গে তামাশা ও হাস্য-রসিকতার শামিল।
তিনি বলেন, আমরা সবাই জানি, কেউ কেবলমাত্র বিরক্ত হলেই প্যাঁ প্যাঁ না করতে বলে। একদিকে ভারত থেকে তিস্তার পানি আদায়ে ব্যর্থতা, অপরদিকে অসহায় মানুষের সঙ্গে এ নিয়ে তামাশা- এটি জাতির জন্য নিতান্তই দুঃখজনক।
শেখ হাসিনা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করেছেন। তিস্তা চুক্তি তাদের এজেন্ডাতেই স্থান পায়নি। অনেকে মনে করেন, পানি মানুষের জীবন, জীবিকা ও জলবায়ুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং পানি নিয়ে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ফখরুল বলেন, একতরফাভাবে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়ার জন্য এ চুক্তি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। তাহলে শেখ হাসিনা কীভাবে দাবি করেন যে এই রেল ট্রানজিট বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসবে? অপরদিকে এই রেল ট্রানজিটের কোনো সমীক্ষা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
তিনি বলেন, ভারতে চিকিৎসা প্রার্থীদের ভিসা সহজ করতে ই-ভিসা চিকিৎসাসেবায় আমাদের আরও বেশি পরনির্ভর করবে। প্রয়োজন ছিল আমাদের দেশেই চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তার কার্যকর চুক্তি।
ফখরুলের ভাষ্য, কোনো দেশের সরকারপ্রধান নিজ থেকে দেশের মানুষকে অন্য দেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে, এটি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিএনপির দাবি, আইসিটি নিয়ে সহযোগিতার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ সহায়তা বৃদ্ধির সহযোগিতার বিষয় ভবিষ্যতে আমাদের নিরাপত্তা সুসংহতকরণে বিরূপ প্রভাব ফেলবে মর্মে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। রাডার পরিচালনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ যদি প্রতিবেশীর হাতে থাকে, তাহলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ২০২২ সালের এক এমওইউতে উল্লিখিত ভারতীয় রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে হিলি-মেঘালয় প্রশস্ত সড়ক সংযোগ ও ১১ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র সেতু বিশেষ সামরিক পরিস্থিতিতে সমগ্র রংপুর বিভাগকেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
তিনি বলেন, ভারত কেবল আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়; সরকারি প্রশাসনযন্ত্র, জাতিগঠনমূলক নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক প্রকল্প, যেমন- রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাডার স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করছে। এক্ষণে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হলে আমাদের সার্বভৌমত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
যে সমুদ্র সম্পদের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশের সেই সমুদ্র সম্পদকেই ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আকাশ সীমান্ত ভারতের হাতে তুলে দিতেই যৌথ স্যাটেলাইট নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে। বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, দলের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিহউল্লাহ ও জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন।
http://dlvr.it/T8z6w9
0 Comments