আমার বাবা আশা করছিলো পরিবারের জন্য মেলা কিছু করবো। আমারে কোনো কষ্ট করতে দিতো না। বাবা কইতো- মা, তুমি আমারে বড় করতে অনেক কষ্ট করছো। আমি এখন বড় হইছি। তোমার কোনো কষ্ট নাই। আমি সব কষ্ট পূরণ করবো। কইছিলো- এখন তুমি অনেক সুখী হবা। কিন্তু সুখী তো হইতে পারলাম না। সব কাইড়া নিলো ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি। আমার পোলার ওপর দিয়া গাড়ি তুইলা দিয়া মাইরা ফালাইলো।
শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নিহত মাহবুব আলমের মা মাহফুজা খানম কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিউজবাংলাকে বলছিলেন কথাগুলো।
গত ৪ আগস্ট বিকেলে শেরপুর শহরের কলেজ মোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল চলাকালে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুতগতির গাড়ির চাপায় মাহবুব আলম নিহত হন। ওইদিন শেরপুরে মোট পাঁচজন নিহত হওয়ার কথা শোনা যায়।
নিহত অন্যদের মধ্যে রয়েছেন- ঝিনাইগাতী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের শারদুল আশিষ সৌরভ, শ্রীবরদী উপজেলার রূপারপাড়া গ্রামের সবুজ হাসান। ওইদিন গাড়িচাপা ও গুলিবিদ্ধ হয়ে এই তিনজনসহ পাঁচ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও আর দুজনের নাম-পরিচয় এখনেও পাওয়া যায়নি।
মাহবুবের বাবা মিরাজ আলী ১৭ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। মা ও বড় বোন মাহবুবকে গার্মেন্টসে কাজ করে পড়াশোনা করিয়েছেন। তাদের আট শতক জমির বসতভিটা ছাড়া কোনো জমিজমাও নেই। তাই মাহবুবকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আন্দোলনে শেষ হয়ে গেছে সব স্বপ্ন।
নিহত মাহবুব আলমের পরিবার জানায়, শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের দরিদ্র মিরাজ আলীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মাহবুব আলম ছিলেন চতুর্থ। বড় দুই বোন মিলিনা ও সেলিনার বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট বোন মারিয়া চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মাহবুবের তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ছিলো। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করার সময় আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাহবুবের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখে মা মাহফুজা কাঁদছেন। ভাতিজার স্মৃতি মনে করে অঝোরে কাঁদছিলেন তার বয়স্ক জেঠা। অর্থাভাবে কাঁচা ভিটির ওপর নির্মিত মাহবুবদের টিনের বসতবাড়ি ও রান্নাঘরটি জরাজীর্ণ। নতুন একটি ঘর তৈরির জন্য মাহবুব কয়েক দিন আগে হাজারখানেক ইট কিনেছিলেন। সেগুলোও বাড়ির ভেতরে জড়ো করে রাখা আছে।
মা মাহফুজা খাতুন বলেন, আমার বাবা খুব কষ্ট কইরা লেখাপড়া করছিলো। লেখাপড়া কইরা আস্তে আস্তে বড় পদে দাঁড়াইতেছিলো। আমার বাবারে ম্যাজিস্ট্রেট কিসের জন্য যে গাড়ি চাপা দিয়া মারলো?
আমার বাবা খুব কষ্ট করছে। মানুষরে কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দিয়া যে টাকা আয় করতো, তা দিয়া ওর নিজের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ চলতো। আমার পোলার স্বপ্ন ম্যাজিস্ট্রেট রাজপথে মিশায় দিছে। যারা আমার পোলারে মারছে, আমি তাদের বিচার ও শাস্তি চাই।
মাহবুবের জেঠা মমতাজ উদ্দিন সরকার তার ভাতিজা হত্যার বিচার দাবি করেন।
মাহবুবের বড় বোন মিলিনা খাতুন বলেন, আমি বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। আমার ভাই কেবলই রোজগার করে আমাদের দেখাশোনা শুরু করছিলো। সেই তো বাড়িতে একমাত্র রোজগার করা ব্যাক্তি ছিলো। এখন আমাদের পরিবার কেমনে চলবে?
স্থানীয় লোপা হামিদ বলেন, মাহবুবের পরিবার যেন চলতে পারে সেজন্য আমরা তার বড় ভাইয়ের চাকরির জন্য একটা ব্যবস্থা চাই। আর মাহবুব হত্যার বিচার চাই।
জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম এ বিষয়ে বলেন, মাহবুব নিহত হওয়ার বিষয়টি তদন্ত না করে তো কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত হওয়ার পর এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। যারা মারা গেছেন তাদের জন্য যদি কোনো ব্যবস্থা করা যায় সে বিষয়টি প্রশাসন দেখবে। আমরা তাদের পাশে থাকব।
http://dlvr.it/TBxhZp
0 Comments