অর্পিত দায়িত্ব যথার্থভাবে প্রতিপালনের রোডম্যাপ অন্তর্বর্তী সরকারকেই নির্দিষ্ট করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের প্রতি আমাদের আস্থাকে প্রশ্নহীন রাখার চ্যালেঞ্জ তাদেরকেই নিতে হবে।
ঝিনাইদহ শহরের প্রাণকেন্দ্র পায়রা চত্বরে শনিবার বিকেলে জেলা বিএনপি আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমরা সবাই জানি, স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে হঠাৎ করে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিকল্প ছিল না। সঙ্গত কারণে আমরা সে সময় তাদের সমর্থন করেছি এবং এখনও তাদের সমর্থন করি। তাদের প্রতি আমাদের আস্থা যাতে অটুট থাকে তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ তাদেরকে নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে পরোক্ষভাবে তারেক রহমান বলেন, সব পরিবর্তন সাধন যেমন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনই এমন দায়িত্বও তাদের কাঁধে নেয়া সঙ্গত হবে না, যেটা তারা বহন করতে সক্ষম হবেন না।
ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে বিএনপি জনসমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মী-সমর্থকদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ জনসভায় দলের খুলনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারি হেলাল, ব্যারিস্টার রুহুল কবির কাজল, ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা, সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মুন্সী কামাল আজাদ পান্নু, সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুর রহমান পপ্পু, যুগ্ম সম্পাদক আসিফ ইকবাল মাখন, জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম পিন্টুসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বক্তব্য দেন।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বক্তব্য, এমনকি প্রতিটি প্রতিক্রিয়ায় প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতার দৃশ্যমান প্রয়োগ। সরকার পরিচালনা একটি অতি সংবেদনশীল ও জটিল কাজ। এখানে সামান্য বিচ্যুতি যেমন বিরাট একটা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে, তেমনই সামান্য অসতর্কতাও অতি আবশ্যক বিশ্বাসকে করতে পারে দুর্বল।
উল্লিখিত কারণে আমাদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দুর ঐক্যে ফাটল ধরানো সহজ হতে পারে। এর যে কোনো একটিই বয়ে আনতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। মনে রাখা দরকার, দেড় যুগ ধরে গড়ে ওঠা স্বৈরাচারের দৃশ্যমান আর অদৃশ্য প্রেতাত্মারা এত সহজে তাদের বিষ-নিঃশ্বাস থেকে আমাদের পরিত্রাণ দেবে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া দলবাজ উচ্ছিষ্ট প্রশাসনের চলমান ষড়যন্ত্রের কাছে আমরা মাঝে মাঝেই সরকার পরিচালনায় দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবানদের অসহায় ও বিপর্যস্ত হতে দেখছি। এর অবসান না হলে, এদের বেড়াজালে আবদ্ধ সরকার ছোট ছোট বিপর্যয়কে এক সময় মহাবিপদ হিসেবে নিজেদের (সরকারের) সামনে দেখতে পাবে। তখন প্রতিকারের পথ হয়ে পড়বে অতি সংকীর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের প্রতি আমাদের সেদিন যে সমর্থন ছিল, সেই সমর্থন আজও আছে। তারা জনগণের যে মূল দায়িত্ব পালনের জন্য আজ দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই দায়িত্ব যাতে তারা সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হন, সেরকম সমর্থন তাদের প্রতি আমাদের অবশ্যই অব্যাহত থাকবে।
বিএনপির এই দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা বলেন, একটি দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী করতে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। জনগণের উন্নয়ন জনগণের নির্বাচিত সরকার দ্বারাই সম্ভব। কারণ, জনগণের সরকার হলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। তাছাড়া জনগণের সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ভোটের মাধ্যমে। তাই যেদিন বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিনই মানুষ তার পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরে পাবে।
তিনি বলেন, আজ আমরা মুক্ত ও ভয়হীন পরিবেশে কথা বলতে পারছি। এই পরিবেশের জন্য দীর্ঘ ১৭ বছর অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে হাজারো মানুষ নিহত ও অনেক মানুষ আহত হয়েছেন। এই সময়কালে শুধু বিএনপিরই ৬০ লাখ নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকে মারা গেছেন। এত মানুষের আত্মত্যাগের কারণ একটাই, তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেতে চান।
তারেক রহমান বলেন, দেশের জন্য ১৯৭১ সালে যেভাবে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মত্যাগ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ২০২৪ সালের আন্দোলনে অনেকে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তবে মনে রাখতে হবে- এই বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন হলেও স্বৈরাচারের দোসররা এখনও রয়ে গেছে। তারা সবসময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই বর্তমান সরকার কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু যেন না করে, যাতে পতিত স্বৈরাচার আবারও মাথাচাড়া দিতে পারে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আজ বাংলাদেশের সব মানুষ প্রত্যাশা করছেন, তাদের প্রিয় দল বিএনপি জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করবে। সে জন্য ১৭ বছর ধরে আমরাও সংগ্রাম করেছি। তাই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বলব, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে বলেই সব বিপদ কেটে যায়নি। আমাদের সবাইকে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক মুক্তি পেলেই হবে না, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে হবে। তা না হলে মানুষের সফলতা আসবে না।
বৈদেশিক বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বিশ্বের আস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি, জনমনে নিরাপত্তা, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের প্রাত্যহিক নাগরিক সুবিধা দিতে একটি নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতার মহাজাগরণ আমাদের সামনে আরেক স্বাধীনতা আর বিজয়ের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে। অতিউৎসাহে আমরা যদি এটাকে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর সফলতা বলে চিহ্নিত করে ফেলি, তাহলে সম্ভবত আমরা আরেকটি ইতিহাস বিকৃতির ফাঁদে পা দেব।
স্বৈরাচার পতনের এই মহা সমরে দেশের সর্বস্তরের মানুষ, রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী-জনতা, গৃহিণী, শ্রমিক সবার অবদানকে আমরা যদি মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হই, কিংবা গত ১৭ বছর ধরে অবিরাম আন্দোলনে গুম, খুন, মামলা, হামলা আর নির্যাতনে পিষ্ট লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মীর অবদানকে যথাযথ মূল্যায়নে অসমর্থ হই তাহলে ইতিহাস আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।
স্থানীয় ওয়াজির আলী উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে জনসভার স্থান নির্ধারিত থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পরবর্তীতে পায়রা চত্বরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর থেকেই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী মিছিল সহকারে সভায় যোগ দেন। আশপাশের জেলা থেকেও বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশে অংশ নেন। এক পর্যায়ে জনসভাস্থল জনসমুদ্রে রূপ নেয়।
http://dlvr.it/TDnCdh
0 Comments