হৃদরোগের জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত রিংয়ের (স্টেন্ট) দাম নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে জরুরি বৈঠক করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিংয়ের দাম সমন্বয়ে জাতীয় কমিটির সদস্যদের নিয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে দামের বিষয়ে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি বলে অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গত ১২ ডিসেম্বর হার্টের স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে দেয়, যা আগের চেয়ে কম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত দামে স্টেন্ট বিক্রি করতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তিন কোম্পানির ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা অনুসরণ করা হলেও রিং সরবরাহকারী ইউরোপের ২৪টি কোম্পানিকে এ তালিকায় রাখা হয়নি।
অধিদপ্তরের ওই সিদ্ধান্তের দিন থেকেই হার্টের রিং সরবরাহ ও ব্যবহার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপের ২৪ রিং সরবরাহকারী ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত এসব ব্যবসায়ী দাম নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ এনে ধর্মঘট ডাক দেন, যা চলমান।
যা বলছে ঔষধ প্রশাসন
রোববার বৈঠকের পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ওনারা (রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) তো হাইকোর্টে গেছেন। জানুয়ারির ২ তারিখে কোর্ট খুলবে। তখন আদালত যে নির্দেশনা দেবে তার আলোকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি।
তিনি বলেন, প্রথমত যে প্রাইস (মূল্য) নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা জনস্বার্থে জাতীয়ভাবে নেয়া সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত তারা যেহেতু বলছে প্রাইস সঠিক নয়, সে হিসেবে অভিযোগ করা হয়েছে এবং কোর্ট খোলার পর নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
জাতীয় কমিটি নতুন করে কোনো নির্দেশনা দেবে কি না- এমন প্রশ্নে নুরুল আলম বলেন, আদালতের নির্দেশনার পর আর কোনো সিদ্ধান্তের দরকার নেই। কারণ সরকার যেটা করেছে জনস্বার্থেই করেছে।
উপ-পরিচালক আরও বলেন, রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রাইসিসের কথা বলছে। তবে এটা আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা সেটাই জানিয়েছেন। তাদের করা রিটের শুনানি ১৮ তারিখে হয়। সেদিন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠকে এদিন জাতীয় কমিটির ১৩ সদস্য এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে হার্টের রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈঠকে ডাকা হয়নি।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি সঠিক মনে হয়নি। তাই শুধু জাতীয় কমিটির সদস্য ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকটা করা হয়েছে।
ইউরোপীয় রিং সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এ বিষয়ে বলেন, তারা জনস্বার্থের কথা বললেও বাস্তবে জনস্বার্থে কিছুই করা হয়নি। বাংলাদেশে যেখানে একেকটি রিংয়ের দাম এখনও ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আছে, সেখানে জনস্বার্থে কী করা হলো?
আমাদের যে রিকয়্যারমেন্ট তার এক-তৃতীয়াংশও পূরণ হচ্ছে না মন্তব্য করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন, অন্যভাবে প্রোডাক্ট চলে আসছে। ওনারা যে মূল্য নির্ধারণ করেছেন, সেটা সবার জন্য সমান করেননি। তাই সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই আমরা মেনে নেব।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, পুরো বিষয়টি আদালতের কাছে তদন্তাধীন। তাই এই মুহূর্তে কিছু বলার সুযোগ নেই।
রিং সরবরাহকারী ২৪ প্রতিষ্ঠানের বিবৃতি
এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের রোববারের বৈঠকের পর একটি বিবৃতি দিয়েছে ২৪ রিং সরবরাহকারী ২৪টি প্রতিষ্ঠান। এতে তারা বলেন, চলমান সংকটের সুরাহা করা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে আমরা জানতে পেরেছি। কোর্ট যে রায় দেবে তার ভিত্তিতে পরবর্তীতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে আলোচনায় আসে। আমরাও মনে করি কোনো সিদ্ধান্ত না আসাটাই স্বাভাবিক।
যে সিদ্ধান্তের কারণে আজকের এই সংকট, সেই কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তাদের আগের সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণিত হবে। তাই তারা কোর্টের সিদ্ধান্তের ওপরই পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে এবং আমরাও মনে করি হাইকোর্ট/সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই সবার প্রতি ন্যায়বিচার করবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সেখানে আরেকটি ব্যাপার আলোচনায় আসে, যে ওনারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা জনস্বার্থে করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের মতামত হলো, ২৭ টি কোম্পানির মধ্যে তিনটি কোম্পানি ছাড়া বাকি ২৪ টি কোম্পানির সাথে যে বৈষম্য মূলক আচরণ করা হয়েছে তা কীভাবে জনগণের স্বার্থ উদ্ধার করে।। মাত্র তিনটি কোম্পানিকে ব্যবসা করার যে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে তা কীভাবে জনগণের স্বার্থ উদ্ধার করে? যে তিনটি কোম্পানিকে পার্শ্ববর্তী দেশে তুলনায় দ্বিগুণ তিন গুণ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা কীভাবে জনগণের সার্থ উদ্ধার করে? উনাদের এই সিদ্ধান্তের কারণে মাত্র তিন থেকে চারটি কোম্পানি হয়তো বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে আর এতে করে জনগণের কাছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রোডাক্ট পছন্দ করার কোন অপশন আর থাকবে না, এতে জনগণের স্বার্থ কিভাবে উদ্ধার করে?
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরা আজকের আলোচনায় ঔষধ প্রশাসনকে জানিয়েছে যে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ আমেরিকান কোম্পানির প্রোডাক্ট আছে, তাই কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। আমাদের মতামত হলো, দেশের মোট হার্টের রিং ব্যবহারের সংখ্যা প্রতি মাসে কম বেশি সাড়ে তিন হাজারের মতো যা এতদিন ধরে মোট ২৭টি কোম্পানি পূরণ করে আসছিল। আর এই চাহিদা যদি এই তিনটি কোম্পানিকে পূরণ করতে হয় তাহলে কমপক্ষে এর তিনগুণ প্রোডাক্ট তাদের স্টকে থাকতে হবে অর্থাৎ ১০ থেকে ১১ হাজার প্রোডাক্ট। বর্তমান সময়ের এই চাহিদার পূরণ করতে হলে এই তিনটি কোম্পানির হাতে প্রতিমাসের অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার প্রোডাক্ট থাকতে হবে। কারণ রিংগুলো সাইজ ভেদে হয়। এই মুহূর্তে প্রত্যেকটি ব্যাংকে যে পরিমাণ ডলার ক্রাইসিস যাচ্ছে তাতে করে এত বিপুল পরিমাণ ডলার দিয়ে এলসি খুলে প্রোডাক্ট আনা প্রায় অসম্ভব। তাই আমরা মনে করি প্রোডাক্ট এর ক্রাইসিস অবশ্যই মার্কেটে আছে। আমরা ওষুধ প্রশাসন এবং সাংবাদিক ভাইদের অনুরোধ করবো সরজমিনে অনুসন্ধান করা হোক এই ব্যাপারে। টেকনিক্যাল কমিটির বাইরে বাংলাদেশে আরও অনেক ডাক্তার আছে তাদের মতামত ও গ্রহণ করা হোক।। আমরা জানি হার্টের রিং সাইজ ভেদে ব্যবহার করা হয় আর তাছাড়া আমেরিকান কোম্পানির সব ধরনের সাইজও হয় না। তাই সাইজের কারণে ক্রাইসিস অবশ্যই থাকবে।
বিশ্বের কোনো দেশই মাত্র তিনটি কোম্পানির উপর নির্ভর করে চলে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে যে তিনটি কোম্পানি থাকলেই হবে তা খুবই হতাশাজনক। পরিশেষে বলতে চাই, প্রোডাক্ট এর সরবরাহ যদি আমেরিকান তিন কোম্পানির পর্যাপ্ত থাকে তাহলে আমাদের প্রশ্ন কিভাবে তারা এটা করছে তা সবার সামনে তুলে ধরার জন্য।
http://dlvr.it/T0p3CH
0 Comments