সাভারের আশুলিয়ায় কর্মহীন যুবকদের চাকরি দেয়ার নামে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। শুধু তাই নয়, আবাসন সুবিধা দেয়ার নামে এসব যুবকদের আটকে রেখে নির্যাতনেরও অভিযোগ আছে নাম সর্বস্ব ভুয়া এ প্রতারক কোম্পানির বিরুদ্ধে।
প্রতারণার শিকার যুবকরা জানান, থানায় অভিযোগ করেও সুরাহা না পেয়ে ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা বিভিন্ন সময় প্রতারক প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিয়ে লাঞ্ছিত ও মারধরের শিকার হচ্ছেন।
এমনি এক ভুক্তভোগী মানিকগঞ্জ জেলার সদর থানার পূর্ব আটি গ্রামের ইউছুব দেওয়ানের ছেলে জাহিদ হাসান। তার খালাত ভাই একই এলাকার মারুফ দেওয়ানসহ এরকম শত শত ভুক্তভোগীর সন্ধান মিলেছে অনুসন্ধানে।
পুলিশ বলছে, এ প্রতারক চক্র ইতোপূর্বে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হলেও নাম ও এলাকা বদলে নতুন নামে শুরু করে প্রতারণা।
ভুক্তভোগী মানিকগঞ্জের জাহিদ হাসান বলেন, কয়েক মাস আগে জামগড়া এলাকায় তার খালাতো ভাই মারুফ দেওয়ান ও আমি ৭০ হাজার টাকা চাকরির জন্য প্রদান করি। আমাদের ভালো বেতনের চাকরি দিবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম ও লিডার রাকিব হাসান জুয়েল, বাপ্পীসহ বেশ কয়েকজন প্রতারক।
এরপর একটি মেসে ৪০ থেকে ৫০ জনসহ আমাদেরকে গাদাগাদি করে রুমে থাকতে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের কোনো বেতন ও কাজ না দিয়ে সারা দিন অহেতুক বিষয়ে ট্রেনিংয়ের নামে সময় পার করতে থাকে তারা।
তিনি আরও বলেন, পরে আমি বেতনের জন্য তাগাদা দিলে আমাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করে। আমাকে সাদা কাগজে জোরপূর্বক টিপসই রেখে দেয় তারা। পরে সেখান থেকে পালিয়ে আমি মানিকগঞ্জ চলে আসি। পরবর্তীতে আশুলিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেও কোন সুরাহা পাইনি।
বরিশালের উজিরপুরের নাসির বেপারীর ছেলে নাদিম হোসেন বলেন, গত মাসে আমার বন্ধু বাপ্পীর মাধ্যমে বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেড নামে আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার একটা কোম্পানিতে চাকরির জন্য আসি। তখন আমাকে ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল ও রাকিবসহ কয়েকজন ৪০ হাজার টাকা নেয়, কিন্তু চাকরি না দিয়ে আমাদের উল্টাপাল্টা ট্রেনিং করিয়ে শুধু সময় পার করতে থাকে।
পরে আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও লাঞ্ছিত করে তারা। একপর্যায়ে আমি সেখান থেকে পালিয়ে ঢাকার পল্টনে আমার মামার বাসায় চলে আসি।
তিনি আরও জানান, আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার একটি ফ্ল্যাটে তাদের ১৬ থেকে ১৭ জনকে আটকে রেখে নামমাত্র খাওয়া দেয়া হতো। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের হুমকি দেয়া হতো। অনেকেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেছেন।
প্রতারণার শিকার নাদিমের মামা ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, আমার ভাগিনা ও তার বন্ধুকে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিএসএন গ্লোবাল একটি নাম সর্বস্ব কোম্পানি। পরে ওদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে কৌশলে ঢাকায় আমার বাসায় পালিয়ে আসে নাদিম। এরপর গত শুক্রবার আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ওই প্রতিষ্ঠানে আমিসহ গেলে তারা টাকা পরিশোধ করবে বলে নানা টালবাহানা করে।
এখনই এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কখনও ডিএক্সএন আবার কখনও বিএসএনসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে যুবকদের চাকরির প্রলোভর দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। কয়েক মাস এক এলাকায় অবস্থান করার পর তাদের প্রতারণা জানাজানি হয়ে গেলে ও অফিসে ভুক্তভোগীরা আসতে শুরু করলে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তারা। সঙ্গে পাল্টে ফেলে প্রতিষ্ঠানের নামও।
এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করলে তাদের হতে হয় লাঞ্ছিত। ঘটে অপ্রীতিকর মারামারির মতো ঘটনাও।
আরও জানা গেছে, এদিকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকায় ইদ্রিসের বাড়ির দ্বিতীয় তলার বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা গেলে তাদের প্রথমে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন প্রতিষ্ঠানের লিডার রাকিবসহ কয়েকজন। ওই সময় ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পেরে সেখানে আরও ভুক্তভোগী ও তাদের স্থানীয় লোকজন জড়ো হলে ম্যানেজার তরিকুল কৌশলে পালিয়ে যান।
তবে পরবর্তী সময় প্রতারক কোম্পানির সত্যতা পেয়ে নিজেরাই তালা ঝুলিয়ে দেয়ার কথা জানান ভবন মালিক ও তার ছেলেরা।
এ ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রতারক কোম্পানির লোকজন স্থানীয় রিয়াজ নামে এক যুবকের সঙ্গে বিবাদে জড়িযে পড়লে ঘটে মারামারির ঘটনা। এতে কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল, লিডার রাকিব হাসান, ভবন মালিকের ছেলে রাকিব, স্থানীয় যুবক রিয়াজ ও গাউছসহ অন্তত ৮ থেকে ১০ জন আহত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, প্রতারণা করে মানুষের কাছে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বিএসএন নামে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে অন্য ভুক্তভোগীর লোকজন, ভবন মালিক ও প্রতারক কোম্পানির দায়িত্বরতরা উপস্থিত ছিলেন। তাৎক্ষণিক আমরা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করেছি।
প্রতারক কোম্পানির লোকজনের মারধরে আহত স্থানীয় যুবক রিয়াজ বলেন, এখানে প্রতারক কোম্পানি খুলে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে এমন খোঁজ পেয়ে আমি কিছুদিন পূর্বে সেখানে গিয়েছিলাম। আমার পরিচিত মেহেদী নামে একজন ওখানে চাকরির জন্য ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছিল। কোম্পানির লোকজন সেই টাকা দিবে বলে নানা টালবাহানা করে আসছিল। পরে গত শনিবার তাদের অফিসের সামনে থেকে আমাকে তারা ডেকে ভেতরে নিয়ে আটকে মারধর করে।
মারধরে আহত অভিযুক্ত রাকিব হাসান বলেন, রিয়াজ নামে ওই যুবক আমাদের অফিসে প্রবেশ করে টাকা দাবি করে আমাকে মারধর করেছে। এর আগেও তাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি।
যদিও তিনি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
ইতোপূর্বে বিএসএন কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম নিজেদের বৈধতা আছে দাবি করলেও কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। পরবর্তী সময় ভুক্তভোগী জাহিদ, মারুফ ও নাহিদসহ প্রতারিত বেশ কয়েকজনের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার কথা জানান তিনি।
তরিকুল বলেন, আগে জামগড়ায় আমাদের অফিস ছিল ডিএক্সএন। ওখানেন জাহাঙ্গীর নামে আমার এক বন্ধু পার্টনার ছিল। মাস খানেকের বেশি হইছে আমরা ওখান থেকে চলে আসছি। এখন যারা যারা অভিযোগ দিতেছে তাদের টাকা আমরা ফেরত দেব।
আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, প্রতারক কোম্পানিতে টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
http://dlvr.it/T40Gxd
0 Comments