Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

রাজধানীতে ১৩ বছর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ গৃহকর্মীর

রাজধানীর একটি বাড়িতে এক রকম আবদ্ধ থেকে এক যুগের বেশি সময় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন এক গৃহকর্মী।
ঠাকুরগাঁও সদরের জামালপুর ইউনিয়নের শিবগঞ্জ বাজার থেকে ঢাকায় যাওয়া ওই গৃহকর্মীর নাম রেখা আক্তার, যিনি শনিবার মধ্যরাতে ফেরেন নিজ বাড়িতে।
রেখার ভাষ্যে ঢাকার জীবন
সাংবাদিকদের রেখা জানান, তার বয়স যখন ১৩ বছর, তখন অভাবের তাড়নায় ব্যবসায়ী মহসিন আলী তাকে ঢাকার ভাড়া বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজের জন্য নিয়ে যান। সেখানে তিনি এক বছর কাজ করেন। ওই সময় মহসিনের অনুপস্থিতিতে প্রায়ই তার স্ত্রী রুনা আক্তার ও তার আত্মীয় লোটাস রেখাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। বাসায় আসতে চাইলেও আসতে দিতেন না। নির্যাতন সইতে না পেরে কোনো এক সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
এ নারী জানান, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো এক নারীর কাছে কাজের সন্ধান চাইলে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যান ওই নারী এবং সে বাড়িতে কাজ করা শুরু করেন।
রেখার ভাষ্য, তখনও জানতেন না বাড়িটিতে তাকে এক প্রকার আবদ্ধ থেকে দীর্ঘ এক যুগ নির্যাতন সহ্য করতে হবে। কাজে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তিনি বাসায় আসতে চাইলে তাকে আসতে দেয়া হয়নি; বরং বাড়ির কথা মুখে নিলেই ঘরের আসবাবপত্র, লোহার রড, কাঠ দিয়ে শুরু হতো অমানুষিক নির্যাতন। সেসব আঘাতের চিহ্ন এখনও নিজ শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এ নারী তার পায়ে কিছু ক্ষত দেখিয়ে সেগুলো আঘাতের বলে জানিয়েছেন।
রেখা বলেন, আমাকে বন্দি করে রাখা হতো। বাসার ময়লা ফেলতে গেলেও সে বাড়ির লোকজন আমাকে পাহারা করত, যাতে আমি পালাতে না পারি।
ভাবলেই বুক কাঁপে আমার। তারা আমাকে আমার বাড়িতে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দেয়নি। আমাকে তালা দিয়ে রাখা হতো।
ঢাকার কোন এলাকায় ছিলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না। শুধু জানি ঢাকা যাওয়ার প্রথম দিকে ভূতের গলি নামের একটি জায়গার আশপাশে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে যে বাসায় কাজ নিয়েছিলাম, তার কোনো কিছুই আমি জানি না। ওই বাড়িতে ঢোকার পর আর বের হওয়ার বা কোনো মানুষের সাথে মেলামেশারও সুযোগ দেয়নি তারা। সারাক্ষণ ঘরবন্দি করে রাখত আর বাড়ির কথা মুখে নিলেই মারধর করত।
কষ্টের বিষয় এ ১৩ বছরে আমাকে কাজের কোনো মজুরি দেননি তারা। এটুকু জানি, সে বাড়ির মালিকের নাম ছিল মাহবুব হোসেন ও তার স্ত্রীর নাম ঝর্ণা আক্তার। আমি সেখানে কাজ শুরুর কিছুদিনের মধ্যে মাহবুব হোসেন আফগানিস্তান চলে যায়। তার স্ত্রী আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।
পালিয়ে যেভাবে ঠাকুরগাঁওয়ে
ঢাকা থেকে কীভাবে পালিয়ে এলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, সেদিন বাসার শোকেসের ওপরে চাবি ছিল। আমি সে চাবি দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। এরপর এক বয়স্ক লোকের কাছে ঘটনা শুনিয়েছি।
তিনি আমাকে ৬০০ টাকা সাহায্য তুলে দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। তারপর বাসের কন্ডাক্টর আমাকে ঠাকুরগাঁও পৌঁছে দেন।
বাড়ি ফিরে কেমন লাগছে জানতে চাইলে অশ্রুসিক্ত নয়নে রেখা বলেন, বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম, আমার বাবা ও চাচা আর পৃথিবীতে নেই। দুর্ঘটনায় মারা গেছে। বাড়ি ফেরার মধ্যে আনন্দ কাজ করলেও বাবা হারানোর কষ্ট আমাকে তাড়া করছে।
শত নির্যাতনের পরেও আমাকে যদি তারা বাড়িতে যোগাযোগ করার সুযোগ দিত, তাহলে অন্তত বাবা মারা যাওয়ার খবরটা জানতে পারতাম।
মায়ের পাশাপাশি দুই বোন ও এক ভাই রয়েছে রেখার পরিবারে। তাদের মধ্যে রেখা সবার বড়।
রেখার ছোট ভাই লিটন আলী বলেন, আমরা শুধু জানতাম, আমাদের এক বড় বোন আছে, যিনি ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে আর ফেরেননি। সে বাড়ি ফিরে আসায় আমরা তাকে প্রথম দেখেছি। বোনের ফিরে আসাতে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
একই কথা বলেন তরুণীর ছোট বোনও।
রেখা ফিরে আসতে দেখে খুশি প্রতিবেশীরাও। তাকে দেখতে ভিড় জমান স্থানীয়রা।
শাস্তি দাবি মায়ের
রেখার মা আনোয়ারা বেগম মেয়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও গৃহে বন্দি রেখে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযোগ করেন।
তার ভাষ্য, যারা আমার মেয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ গৃহবন্দি রেখে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে যেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। আর কোনো মায়ের সন্তানের সাথে এমন যেন না করা হয়।
চুরির অভিযোগ ও প্রত্যাখ্যান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহসিন আলী মোবাইল ফোনে বলেন, ২০১১ সালে আমার স্ত্রী গর্ভবতী থাকার কারণে ঘরের কাজের সহযোগিতার জন্য রেখাকে গ্রাম থেকে এনেছিলাম। সে কাউকে কিছু না বলে বছরখানেক পর বাড়ি থেকে চলে যায়।
ওই সময় রেখার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগে কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বলে জানান মহসিন।
তার ভাষ্য, এ ঘটনায় রেখার পরিবার আমাদের নামে অপহরণ মামলাও করেছিল। আদালত আমাদের খালাস দিয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে তৎকালীন চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে তার পরিবারের সাথে আমরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমাধানও করেছি।
রেখা চুরির এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শুধু নির্যাতনের কারণে মহসিন আলীর ঘর ছেড়েছিলেন তিনি।
সমাজকর্মী ও প্রশাসনের ভাষ্য
এ বিষয়ে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ঠাকুরগাঁওয়ের সদস্য সচিব ও সমাজকর্মী মাহাবুব আলম রুবেল বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর শুনছি। আসলে আমাদের দেশে গৃহকর্মী সুরুক্ষা আইন করা জরুরি।
অন্যান্য পেশাজীবীদের একটা পরিচয়পত্র আছে। অথচ গৃহকর্মীরাও যে চাকরি করে, তার কোনো পরিচয়পত্র নেই। আমার কাছে মনে হয়, এমন অসাবধানতার কারণে এসব ঘটনাগুলো ঘটছে।
পালিয়ে আসা গৃহকর্মীর পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়াত হোসেন।
তিনি বলেন, পরিবারটি যদি আইনগত সহায়তা চায়, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা করা হবে এবং এর জন্য কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না।


http://dlvr.it/T8qZF7

Post a Comment

0 Comments