জীবিকার তাগিদে মাত্র আট বছর বয়সে পাড়ি জমান ঢাকায়। সদরঘাটে শুরু করেন কুলির কাজ। রাতে থাকার মতো জায়গা না থাকায় ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে। এর ফাঁকেই গাড়ি চালানো শেখেন। এক পর্যায়ে বাগিয়ে নেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) গাড়িচালকের চাকরি।
ব্যস, আবেদ আলী ঘুরাতে থাকেন তার ভাগ্যের চাকা। নানা ফন্দি-ফিকিরে কামিয়ে নেন বিপুল অর্থ। সঙ্গে ক্ষমতাও।
তবে শেষরক্ষা হয়নি। পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হোতা ধরা পড়েছেন পুলিশের অপরাধ তদ্ত বিভাগ-সিআইডির জালে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকেসহ মোট ১৭জনকে।
করিৎকর্মা আবেদ আলী পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত- সম্প্রতি মিডিয়ায় এমন খবর প্রচার হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে তার নিজ এলাকা মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামে।
মাদারীপুরে সরকারি জায়গা দখল করে আবেদ আলী নির্মাণ করছেন মার্কেট ও গরুর খামার। ছবি: নিউজবাংলা
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বেতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। আব্দুর রহমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেজ। রহমান মীরের বড় ছেলে জবেদ আলী কৃষি কাজ করেন। ছোট ছেলে সাবেদ আলী এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
আবেদ আলী এলাকার মানুষের কাছে নিজেকে পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। চড়তেন দামি গাড়িতে। তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামও ব্যবহার করতেন দামি গাড়ি। অথচ এলাকার কেউ জানতেনই না যে তিনি সামান্য বেতনভুক্ত একজন গাড়িচালক।
ঢাকায় আবেদ আলী রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেন বলে এলাকায় প্রচার ছিল। কয়েক বছর ধরে এলাকায় ব্যাপক দান-খয়রাতও করে আসছিলেন পিএসসির প্রশ্নফাঁস চক্রের এই হোতা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিত্ত-বৈভব ফুলে-ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবেদ আলী মীর পদবি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। বাবার উত্থান নিয়ে ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও সম্প্রতি এক সমাবেশে বক্তব্য দেন।
বাবার উত্থানের গল্প বলতে গিয়ে সিয়াম বলেন, আমার বাবা একদম ছোট থেকে বড় হয়েছেন। আমার বাবার বয়স যখন আট বছর তখন পেটের দায়ে তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। তিনি কষ্ট করে বড় হয়েছেন।
পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ফাইল ছবি
আবেদ আলী নিজ গ্রামে কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। এছাড়াও সরকারি জায়গা দখল করে তার গরুর খামার ও মার্কেট নির্মাণাধীন। উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে কিনেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ।
সরেজমিনে জানা যায়, পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী। কিন্তু এলাকার মানুষ তার এই পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। গত কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে একশ পরিবারের মধ্যে এক কেজি করে মাংস বণ্টন করেন তিনি। সেই ভিডিও শেয়ার করেন নিজের ফেসবুকে।
আবেদ আলীর ছেলে সিয়াম শুধু একটি গাড়ি নয়, একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। সবই নতুন, ঝকঝকে। পড়েছেন ভারতের শিলংয়ে। দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি পড়ালেখা করেন।
স্থানীয় আব্দুল হক নামে এক ব্যক্তি বলেন, তিনি এলাকায় এলে মানুষকে দায়-খয়রাত করতেন। তার সঙ্গে আমাদেরও ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি যে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তা আমাদের ভাবনায়ও ছিল না। আমরা এলাকাবাসী হতবাক! আমরা চাই বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীর বিচার হোক।
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, যারা অস্বাভাবিকভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের নিয়ে সচেতন মহলের প্রশ্ন তোলা উচিত। সরকারের উচিত, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। প্রশ্ন ফাঁস করে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার কারণে তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনের মধ্যে সৈয়দ আবেদ আলী ছাড়াও রয়েছেন পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তা ও একজন অফিস সহকারী।
বেসরকারি টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির ও নিখিল চন্দ্র রায়, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান।
সংঘবদ্ধ চক্রটি বিপিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠত।
চক্রটি ৫ জুলাই (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাকে টাকা কামানোর মওকা হিসেবে বেছে নেয়। এই পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির তথ্য ফাঁস করতে ছদ্মবেশ ধারণ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিম। ছদ্মবেশী এক নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থীকে তুলে দেয়া হয় চক্রের সদস্যদের হাতে। এরপর ৫ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত যে প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, হোয়াটসঅ্যাপে তার একটা কপি পাঠানো হয় পরীক্ষার অন্তত এক ঘণ্টা আগে। আর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের তা পড়ানো হয় আগের রাতেই।
চক্রটির প্রধান বিপিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম বলেন, উপ-পরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে শুক্রবার (৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। তিনি বড় কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন আমাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন। আমি এটাও জানি যে ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।
প্রকাশিত সংবাদে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচনায় আসেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। সোমবার দুপুর থেকে বাবা ও ছেলের নানা কর্মকাণ্ডের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
http://dlvr.it/T9KMgK
0 Comments