Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বরাদ্দের টাকায় অনিয়মের অভিযোগ

কিশোরগঞ্জে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও জানেন না কৃষকরা।
আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি এসেছে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।
কৃষকদের জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বরাদ্দের পুরোটাই এ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে একটি স্পেশাল বরাদ্দ আসে কিশোরগঞ্জে। সেটিও এ কর্মকর্তা ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বরাদ্দে ছিল চার লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এসবের বাইরে কৃষকের মাঠ দিবস, প্রশিক্ষণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত সাখাওয়াত হোসেন ২০২৩ সালের ২৮ মে থেকে নিকলী উপজেলায় কর্মরত।
কোন খাতে কী বরাদ্দ জানেন না উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রদর্শনীর বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় বাবদ সরকার বরাদ্দ দেয় উপজেলা কর্মকর্তা বরাবর। প্রদর্শনী অনুযায়ী কৃষক নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে। তারা কৃষক নির্বাচন করে নিশ্চিত করেন উপজেলা কর্মকর্তাকে।
একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে উপসহকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা।
নিয়ম অনুযায়ী, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষক নির্বাচন করে উপজেলা অফিসে জমা দেবেন। পরবর্তী সময়ে কৃষি কর্মকর্তা উপকরণ কিনে নির্ধারিত একটি তারিখে কৃষকদের অফিসে আসতে বলবেন। পরে সেখান থেকে উপকরণ বিতরণ রেজিস্ট্রারে (স্টক রেজিস্ট্রার) সাক্ষর রেখে মালামাল বুঝিয়ে দেয়া হয় কৃষককে। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো উপসহকারীর সঙ্গে সমন্বয় করেননি।
সমন্বয় না করলে প্রদর্শনীতে কী কী উপকরণ বরাদ্দ এসেছে সেগুলো উপসহকারী কর্মকর্তা কিংবা কৃষকদের জানারও সুযোগ থাকে না।
নিকলী সদর ইউনিয়নের ষাইটধার গ্রামের কৃষক মিয়া হোসেন জানান, বিগত দুই বছর পূর্বে ৮০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন তিনি। তখন ১০ কেজি বীজ, এক বস্তা ইউরিয়া আর এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি। এরপর আর তার অনুকূলে কোনো বরাদ্দ আসেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিকলী উপজেলার গুরই, সিংপুর ও সদর ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানান, অন্যান্য বছর আগস্টের মধ্যেই তাদের ভাসমান বেড তৈরির বরাদ্দ দেয়া হতো। এবার তাদের কাউকেই কোনো প্রকার বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে তারা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করার পর তাদের জানানো হয়েছে, এ বছরের বরাদ্দ আসেনি।
কৃষকরা জানান, বরাদ্দ এলে তাদের দেয়া হবে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
প্রান্তিক কৃষকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান শুরু করে নিউজবাংলা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় আলাদা তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি আসে এ প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বরাদ্দ আসার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন। খানিকটা পর বলেন, কয়েকটা ছোট বরাদ্দ এসেছে। পানি বেশি থাকায় সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অচিরেই সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
একপর্যায়ে বরাদ্দের কপি দেখানোর পর বিশেষ বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরা তার ব্যাচমেট। হঠাৎ একদিন হীরা তাকে ফোনে বলেন, তোমার নামে একটি স্পেশাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তুমি বরাদ্দের টাকাটা উত্তোলন করে আমাকে পাঠিয়ে দাও। অফিসের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচে সেটি ব্যয় করা হবে। তিনিও তার কথামতো সেটি করেছেন।
তিনি বলেন, আপনারাও তো বোঝেন, অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও সেটি করেছি।
তারপরও বিষয়টি যেহেতু আপনাদের নজরে চলে এসেছে আমি তার সাথে কথা বলে অচিরেই বাস্তবায়ন করে নেব।
এ কথার একপর্যায়ে তিনি ফোনে কথা বলেন হীরা নামের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে।
সাখাওয়াত তাকে বলেন, তুমি যে একটা স্পেশাল বরাদ্দ দিয়েছিলে, সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে।
নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আরও আছে। এর আগে এ কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। সেখানেও তার বিরুদ্ধে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ, সার, বীজসহ বিভিন্ন প্রণোদনার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে।
এ বিষয়ে জাতীয় একটি পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। পরে সেখান থেকে তাকে বদলি করা হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে, তবে সেখানে গিয়ে বেশি দিন থাকতে হয়নি তার। তিনি চলে আসেন কিশোরগঞ্জের নিকলীতে।
মোহনগঞ্জে থাকা অবস্থায় অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেখানে কোনো প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি করেননি বলে দাবি করেন সাখাওয়াত।
এ কর্মকর্তার দাবি, সেখানকার এক সাংবাদিক তার কাছে থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। দেননি বলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন।
যা বললেন তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক
কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ প্রকল্পের মেয়াদ আগস্টেই শেষ হয়ে যায়। এ প্রকল্পের সবকিছুই ক্লোজ হয়ে গেছে। তিনিও বর্তমানে এ প্রকল্পের দায়িত্বে নেই।
তিনি জানান, তার জানা মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দও কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। তারপরও যদি কোনো কর্মকর্তা সেটি বাস্তবায়ন না করে আত্মসাৎ করে থাকেন, তবে এর দায়ভার একান্তই তার।
প্রকল্পগুলো কী ও বরাদ্দের পরিমাণ কত
কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের অনুকূলে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ভাসমান বেডে মসলা, লতাজাতীয় ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনী রাজস্ব ব্যয় বাবদ নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। লতাজাতীয় ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার (প্রতিটি প্রদর্শনীর ব্যয় ১০ হাজার) টাকা ও লতাবিহীন ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ মে পাওয়া এ বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনীর জন্য ২০২৪ সালের ২১ মে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ বরাদ্দ দেয়া হয় তিন লাখ টাকা।
ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীতে পাঁচটিতে বরাদ্দ ৫০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ১০টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ১ লাখ টাকা। এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজির ১৫টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় দেড় লাখ টাকা। এখানে ৩০টি প্রদর্শনীতে মোট তিন লাখ টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
একই বছরের ৬ জুন ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীর ১১টিতে বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ৯টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৯০ হাজার টাকা।
এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজি চারটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৪০ হাজার টাকা। এখানে ২৪টি প্রদর্শনীতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালকের ভাষ্য
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়ম বা আত্মসাৎ করে থাকেন এবং তদন্তে এসবের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।


http://dlvr.it/TDMwxX

Post a Comment

0 Comments