বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি দেশের চিকিৎসাসেবা এবং ডাক্তারদের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করছে। এতে সাধারণ মানুষকে প্রচণ্ড ভুগতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রাম ও বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোর অতিরিক্ত মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি আমাদের চিকিৎসাসেবা এবং ডাক্তারদের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। অনেক সময় শোনা যায়, রোগীকে আইসিইউতে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাও দিয়ে রেখেছেন। রোগী এমনিতেই মৃত্যুবরণ করবে, তাকে লাইফ সাপোর্টে দিচ্ছে। এরকম ঘটনা অহরহ শুনতে পাই। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও ভুমিকা রাখতে পারে। এব্যাপারে সবচেয়ে প্রয়োজন সদিচ্ছার।
স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বর্তমান সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এই উদ্যোগের সুফল যেন সাধারণ মানুষ পায় এবং ডাক্তার এবং হাসপাতালের ওপর যাতে মানুষ আস্থা স্থাপন করতে পারে। এটি সফল করতে এসবের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদের আরও কিছু কাজ করা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা ইঙ্গিত করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজকে জি-২০ সম্মেলনে যাচ্ছেন, জি-২০র বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভারত। এই উপমহাদেশ থেকে আর কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
গতকাল রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী আসবেন। কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বহুমুখি সহযোগিতা এবং বহুমাত্রিক সম্পর্কের প্রমাণ হচ্ছে তাদের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সংলাপ।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমাদের সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে গত প্রায় ১৫ বছরে সরকারি-বেসরকারি বহু মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত করেছে। সারা দেশে প্রায় ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে দেশে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩০ প্রকারের ঔষধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এটি আশপাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ কোথাও নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে গেছে বিধায় স্বাধীনতার পর আমাদের গড় আয়ু যেখানে ছিল ৩৯ বছর, সেটি এখন ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছানোর পাশাপাশি ডাক্তার এবং হাসপাতালের ওপর যাতে মানুষ ভরসা করতে পারে, সেজন্য মানুষের আস্থা অর্জন প্রয়োজন উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিদেশমুখী অনেক রোগীকে আমি জিজ্ঞেস করি- ভারতের ব্যাঙ্গালুরু, দিল্লি, কলকাতাসহ বিভিন্ন রাজ্যে এত ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে কেন যান? তখন তারা বলেন- বাংলাদেশে তো ডাক্তার ভালো করে কথাই বলেন না। যিনি চালু ডাক্তার তার অ্যাসিট্যান্টরা রোগী দেখেন। আর তিনি দুমিনিট কথা বলেন। আর বিদেশে ডাক্তাররা প্রয়োজনে আধঘণ্টা কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমাদের ডাক্তাররা অনেক মেধাবী। আমাদের একজন ডাক্তার যদি ভালো করে রোগী দেখেন, তিনি যেই ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন, সেটি ইউরোপ আমেরিকায়ও দিতে পারে না। আমি ইউরোপে অনেকদিন ছিলাম। সেখানকার ডাক্তারদের তুলনায় আমাদের দেশের ডাক্তারদের আইকিউ অনেক বেশি। আমাদের ডাক্তারদের অভিজ্ঞতালব্দ যে জ্ঞান, সেটা ইউরোপের ডাক্তারদের নাই। কিন্তু যত ভালো ছাত্রই হোক, মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা না দিলে যেমন পরীক্ষা ভালো হয় না, তেমনি মনযোগ দিয়ে রোগী না দেখলে তো রোগীই ভালো হবে না।
প্রতিবছর মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। আমাদের মেধাবী ডাক্তাররা যদি আরেকটু মনযোগ দিয়ে রোগী দেখতেন, তাহলে বিদেশমুখী রোগীরা আর যেতেন না।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, অন্যান্য ডিসিপ্লিনি এবং মেডিক্যাল বিষয়ে পড়ালেখায় বিরাট একটা পার্থক্য আছে। মেডিক্যাল কলেজে যারা ভর্তি হন, তারা শুরুতেই একটা শপথ নেন মানব সেবার। মানবসেবা করার বিরাট একটা সুযোগ স্বাস্থ্যসেবা পেশার সঙ্গে যুক্তদের ছাড়া অন্যদের করা সম্ভব নয়। এজন্য আমি তোমাদের অনুরোধ জানাব, ভালো ডাক্তার হয়ে, ভালো উপার্জন করার মানসিকতা নয়, মানবসেবার মানসিকতা লালন করে মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনার জন্য।
ড. হাছান বলেন, যারা ডাক্তার হবে বা হয়েছ, তারা যদি সবাই সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রতি সপ্তাহে একদিন বিনামূল্যে রোগী দেখবেন, তাহলে দেশের বেশিরভাগ গরীব রোগীর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সেটি খুব কম ডাক্তারই করেন। এই বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের মনের গভীরে প্রোথিত করা প্রয়োজন। একজন দরিদ্র রোগী যখন অসুস্থ হয়, তার স্বজনদের হাসপাতালে এসে টাকা পরিশোধ করা যে কী কষ্টসাধ্য, সেটি আমাদের ভাবতে হবে। সেটি মাথায় রেখে যদি স্বল্প কিংবা বিনামূল্যে সেবা দেয়া যায়, তাহলে সত্যিকারের মানবতার সেবা দেয়া হবে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল সাশ্রয়ীমূল্যে ও গরীবদের বিনামূলে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উদাহরণ তৈরি করবে বলে এসময় আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী। বলেন, এখন ডেঙ্গু নিয়েও অপপ্রচার শুরু করেছে। মনে হচ্ছে ডেঙ্গু মশার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। ডেঙ্গু মশা আওয়ামী লীগ, বিএনপি চিনে না। আমাদের সরকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় এবং জনগণের সচেতনতায় আমরা ডেঙ্গু সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারব, যেভাবে করোনাকে মোকাবেলা করেছি।
তিনি বলেন, মূর্খরা বলেন- ডেঙ্গেু যেমন মারাত্মক, বিএনপি তার চেয়েও মারাত্মক। ডেঙ্গু মশা কামড়ায় আর বিএনপি মানুষ পোড়ায়। আসলে অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর চেয়েও বিএনপি মারাত্মক। আমরা সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত দেশ রচনা নয়, আমরা বস্তুগত উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটি সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চাই। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্তদের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ম্যানেজিং ট্রাস্টি মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. ইসমাইল খান, ট্রাস্টি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সৈয়দ মোরশেদ হোসেন, অধ্যক্ষ প্রফেসর অসীম বড়ুয়া প্রমুখ।
http://dlvr.it/Svq8fP
0 Comments