দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে প্রথম মাইক সার্ভিস কল-রেডী এখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের জন্য ব্যবহৃত সেই মাইক্রোফোনটি ছিল এই কল-রেডীর।
প্রতিষ্ঠানটির আদি প্রতিষ্ঠাতা দয়াল ঘোষ ২০০৪ সালে মারা গেছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন বিশ্বনাথ ঘোষ, শিবনাথ ঘোষ, ত্রিনাথ ঘোষ সাগর ও সম্বোনাথ ঘোষ রানা। তারাই ধরে রেখেছেন বাবা-চাচার ব্যবসা ও স্মৃতি।
ইতিহাসের চূড়াস্পর্শী সেই ভাষণে ব্যবহার করা মাইক্রোফোন, মাইক, হর্ন, এমপ্লিফায়ার, স্ট্যান্ডসহ আরও সরঞ্জাম সংরক্ষণে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ৭ মার্চ ভাষণে ব্যবহৃত সরঞ্জামের ৪০ ভাগ তারা সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। কালের সাক্ষী কল-রেডীর ঐতিহাসিক যন্ত্রপাতি বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়ে বর্তমানে সেগুলো বিদেশে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
দীর্ঘ এই সময়ে সরকারিভাবে যথাযথ সম্মান বা গুরুত্ব না পাওয়ার ক্ষোভে সেই মাইক্রোফোনটি নিলামে বিক্রির চিন্তাভাবনাও করছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধাররা।
দেশ বিভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অকুতভয়ে মাইক সার্ভিস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে এই সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও সরকারি কোনো স্বীকৃতি পায়নি।
এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধারেরা। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এসব যন্ত্রপাতির যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় জাদুঘরে রাখার দাবি জানিয়েছে আসছিলেন।
কল-রেডীর ইতিহাস নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্ণধার ত্রিনাথ ঘোষ সাগর জানান, ১৯৪৮ সালের দিকে দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ নামে দুই ভাই পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে আরজু লাইট হাউজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নাম দেন কল-রেডী। অর্থাৎ কল করলেই রেডি। এরপর একে একে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনের সামনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিকরা। ১৯৭১ এ ইতিহাসিক ৭ই মার্চের সমাবেশে মাইক সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার করা হয় কল-রেডী।
তিনি বলেন, ৭ মার্চে কল-রেডীর যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই মাইক্রোফোন আর কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেও কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।
৭ মার্চে মাইক সার্ভিস দেয়ার বিষয়ে ত্রিনাথ ঘোষ সাগর বলেন, বাবার মুখে শুনেছি, ৭ মার্চের ৩ দিন আগে বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসায় আমার বাবা হরিপদ ঘোষ ও জ্যাঠা দয়াল ঘোষকে ডেকে সমাবেশে মাইকের ব্যবস্থা করতে বলেন। সেদিন একশোর অধিক মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশস্থলে।
সমাবেশের তিন দিন পূর্ব থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কল-রেডী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রাখা হয়। কিন্তু স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুতে জীবন বিপন্নের ভয় ও এতো বড় সমাবেশে মাইক ভাড়ার খরচ বেশি হওয়ার কারণে অনেকে তাদের মানা করেন। কিন্তু স্বাধীনতার ডাকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে মাঠে মাইক লাগান বাবা ও অন্যরা। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন তারা।
আরেক কর্ণধার বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যান্ত্রিক ত্রুটি যেন না হয় সেজন্য অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন, কিছু হ্যান্ড মাইক ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগসহ নিজেরা উপস্থিত ছিলেন। তবে এতে ভয়ও ছিল। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে কাজ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পাকিস্তানি সামরিক সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) সৈন্য মোতায়েন করে। যেকোন সময় হতে পারে তাদের আক্রমণ।
তাই এমন উৎকণ্ঠিত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে শুধু টাকার জন্য সাড়া দেয়নি কল-রেডী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হুমকির মুখে রাতের অন্ধকারে সেদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষের সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে মাইকের আয়োজন করে কল-রেডী।
এ সময় তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের সাক্ষী হতে পরে কল-রেডী গর্ববোধ করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই স্টান্ড, মাইক্রোফোন সবই আছে। কিন্তু কল-রেডীর কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। সরকার এগুলো যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও কল-রেডীর ইতিহাস সংরক্ষিত হবে।
৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ব্যবহার করেন বর্তমানে কল-রেডীর কাছে সংরক্ষিত আছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সেসব হস্তান্তর করবেন বলে জানান সাগর ঘোষ।
দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী কল-রেডী। ছবি: নিউজবাংলা
বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, ইতিহাসের অংশ আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। খুব গর্ব হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাইকে কথা বলে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন- এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে! আমরা সেই মাইক্রোফোন সংরক্ষণ করে রেখেছি। চাইলে যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেব। কেননা এগুলো আরো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
৭ মার্চের ভাষণের দিনের আগে আগে বঙ্গবন্ধু দয়াল ঘোষকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। দয়াল ঘোষের ছেলে বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, বাবাকে সারা শহরে মাইক সেট করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই অনুযায়ী শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তিন শতাধিক হর্ন লাগানো হয়েছিল, যাতে লাখো মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ভাষণ পৌঁছানো যায়।
৭ মার্চের ভাষণ সমাবেশস্থল ও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষজনের কাছে যাতে পৌঁছায়, সে জন্য বঙ্গবন্ধুর সামনে ও পাশে অন্তত ২০টি মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছিল।
সরেজমিনে কলরেডির সংগ্রহশালায় ঘুরে ততকালীন সময়ে ব্যবহৃত বেশ কিছু মাইক্রোফোন দেখা যায়। যেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, অটল বিহারি বাজপেয়ি, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিল ক্লিনটনসহ দেশ ও বিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আরও অনেকে। এগুলো দেশের স্বাধীনতা যাদুঘরে সংগ্রহ করে যথাযথ স্বীকৃতি মিললে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রক্ষিত থাকবে বলে মনে করেন কল-রেডীর বর্তমান কর্ণধাররা।
কল-রেডীর ইতিহাস নিয়ে জানতে চাইলে বর্তমাম কর্ণধাররা জানান, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ইসলামপুরে কাপড়ের পাইকারী দোকান দেবেন দুই সন্তান। কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল না কাপড়ের ব্যবসায়। কারণ পুরান ঢাকায় কাপড়ের দোকানের অভাব ছিল না।
দুই ভাই তখন সিদ্ধান্ত নেন বাতি ও লাইটের ব্যবসা করবেন। পুরান ঢাকার মানুষ আলোকসজ্জা পছন্দ করে, বেশ ভালো চলবে। এরপর দুজন ১৯৪৮ সালে আরজু লাইট হাউস নামে একটি দোকান চালু করেন।
দোকানের প্রথম গ্রাহক ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল। তিন টাকা অগ্রিম দিয়ে তিনি বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে। কিন্তু সমসাময়িক আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠায় শঙ্কায় পড়েন তারা।
এমন সময় বুদ্ধি খাটিয়ে লাইটের পাশাপাশি ব্যবসায় সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন হরিপদ ঘোষাল। শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগল।
প্রথম দিকে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে এসে এবং নিজেরাই হ্যান্ড মাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেয়া শুরু করেন। কিন্তু এক সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আনতে হয় দুই ভাইকে।
কল-রেডী নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডি থাকে এই ভাবনা থেকেই নামটি এসেছে। অর্থাৎ কল করলে মাইক পৌঁছে যাবে দ্রুত। কল-রেডী দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয়।
কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশিদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রমুখ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্ব পালন করে কল-রেডী। এই ভাষণ সেদিন ৭ কোটি বাঙালির পথের দিশা দেখিয়েছিল। ভাষণটি এখন বৈশ্বিক সম্পদ। ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে।
এর আগে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা ভাষণগুলো নিয়ে উই শ্যাল ফাই অন দ্য বিচেস: স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন।
http://dlvr.it/T3kBMD
0 Comments